Spread the love

শ্রীজিৎ চট্টরাজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। একে তো ভ্যালেন্টাইন ডে। তার ওপর সরস্বতী পুজো। বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে। যেন রাজযোটক। প্রেমিক প্রেমিকার একান্তে দেখার দিন। সেদিন অন্য কারো যুগলের মধ্যে কাবাব মে হাড্ডি হওয়া অশোভন শুধু নয়, রীতিমতো অপসংস্কৃতি। কাবাবের কথা যখন উঠল তখন তো বঙ্গতনয় অভিষেক বোসের কথা বলতেই হয়।উত্তর কলকাতার হাতিবাগান মোড় থেকে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে যেতে কয়েক পা হাঁটলেই অভিষেকের বারবিকিউ ফুড ষ্টল। করোনার আগে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ছিল পেশা। দু:সময় কাটিয়ে নতুন করে জীবন সংগ্রাম। ফাস্ট ফুডের ব্যবসায় অভিষেকের অভিষেক। গত ২৬ জানুয়ারি থেকে হাতিবাগানে সেনকো জুয়েলারির বিপরীতে বাডিস্ কিচেনের পরিক্রমা শুরু। বুধবার সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যায় মিডিয়ার সঙ্গে পরিচিত হলেন। স্টলে এই মুহূর্তে মিলছে হাতে গরম বেশ কয়েক ধরনের কাবাব। এককথায় বলা যায় দুয়ারে বারবিকিউ। মাত্র ষাট টাকায় মালাই কাবাব, লাহরি কাবাব , শাহী কাবাব, আচারি কাবাব, রেশমি কাবাব , হরিয়ালি কাবাব। মশলা মাখানো চিকেন উইংস মিলছে পঞ্চাশ টাকায়। আফগানি চিকেন লেগ একশ টাকায়। সঙ্গে জিভকে সুখে রাখতে মেয়োনিজ আর টমেটো সসের সংযোজন। এদিনের অনুষ্ঠানে অভিষেক বোসকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন সিরিয়াল খ্যাত দুই অভিনেত্রী মৌমিতা বিশ্বাস ও নীলাঞ্জনা মজুমদার।

বাঙালির সঙ্গে কাবাবের প্রণয় বহুদিনের। রবীন্দ্রনাথ থেকে বিবেকানন্দ। কাবাবের অভাব তাঁরা জীবনে বুঝতে দেননি। রবীন্দ্রজায়া মৃণালিনী দেবী কবিকে চিকেন কাবাব নোসি, তুর্কি কাবাব, শ্রুতি মিঠা কাবাব তৈরি করে খাওয়াতেন। পারস্য আর তুরস্কের সীমানা পেরিয়ে কাবাব ভারতে আসার কথা লিখে গেছেন পরিব্রাজক ইবন বতুতা। রাজ পরিবারে শুধু নয়, আমজনতার রসনা তৃপ্তিতে কাবাবের জবাব ছিল না। প্রত্নতত্ববিদেরা বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতায় কাবাবের হদিশ মেলে। আরমিয়হ ভাষায় কাবাব অর্থ সেদ্ধ মাংসের মুইঠ্যা। ইংরেজিতে যাকে বলে মিট বল। পরবর্তী সময়ে শিকে গাঁথা মশলার আরকে চোবানো মাংসের কিমা শিকে ঝলসানো মাংসকে কাবাব বলা শুরু। সঠিক উচ্চারণ শিশ কাবাব। ফার্সিতে শিশ শব্দের অর্থ শলাকা। কভারেজ কাটলেট যেমন বাংলায় কবিরাজি হয়ে যায় তেমন শিশ কাবাব হয়েছে শিক কাবাব। বেদ , রামায়ণ মহাভারতে শূল্য পক্ক মাংসের কথা আছে। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের বাংলা অনুবাদে বাল্মীকি রামায়ণের সুন্দর কাণ্ডে যেমন লঙ্কার রন্ধনশালার বর্ণনায় সেযুগের কাবাবের বর্ণনা আছে, তেমন অযোধ্যাকাণ্ডের (৫২/১০২) এ উল্লেখ আছে তৌ তত্র হত্বা চতুরো মহামৃগান৷ বরাহম ঋষ্যাং পৃষতং মহারুরুম্।। আদায় মেধাং ত্বরিততং বুভূক্ষিতৌ ।বাসায় কালে যযতুর্বনস্পতিম।। অর্থাৎ বনবাসের প্রথম প্রবেশের পর রাম লক্ষ্মণ বরাহ ও অন্য তিন রকম পশু বধ করে স্বাদ গ্রহণ করেন। সম্ভবত বনবাসে দ্রুত খাদ্য প্রস্তুত করতে আগুনে ঝলসানো ছাড়া উপায় কি? তবে আগুনে ঝলসালেই তা কাবাব হয় না।

শিল্প নৈপুণ্যে কাবাব অনেকরকম। সরাসরি আগুনে ঝলসালে বলা হয় বড়া কাবাব, তন্দুর উনুনে ঝলসালে তন্দুরি, তাওয়াতে ভাজলে কাকোরি কাবাব শিকে গেঁথে মাংস ঝলসালে শিশ কাবাব কাঠ কয়লা বা হিটারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাংস ঝলসালে সেটা হয় দোনার কাবাব। ইতিহাস বলছে, ঠাকুরবাড়িতে রসনা তৃপ্তির জন্য তৈরি হয় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে একটি ক্লাব। বছর বছর ক্লাবের সভাপতি বদল হতো। একবার ঠাকুরবাড়ির বন্ধু হিসেবে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন সভাপতি হতে চান। ঠিক হয় নতুন কোনো অসাধারণ খাদ্য পরিবেশন করে সভাপতি হতে পারেন তিনি। শাহী মুঘল রান্না করেও ক্লাবের সদস্যদের মন জয় হলো না। ফলে সভাপতি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার যোগাড়। শেষে অবন ঠাকুরের সহযোগিতায় কাবাব বানিয়ে কবি নাম দিলেন নিজের নাম মিলিয়ে জসি কাবাব। সভাপতির পদ পেতে জসীমউদ্দীনের আর লড়াই করতে হয়নি। কাবাবের সঙ্গে বাঙালির যে স্বভাবজাত সম্পর্ক প্রাচীন, সে কথা বোধ হয় উত্তর কলকাতার যুবক অভিষেক বোস আর একবার মনে করিয়ে দিতে ছোট্ট স্টলে খুলে ফেললেন বাডিস্ কিচেন। রসালো চিকেন জোরালো ঘি মশলার যুগলবন্দিতে লোভনীয় কাবাবের স্বাদ গ্রহণের জন্য কলকাতা শুধু নয়, জেলার মানুষকেও টেনে আনবেন হ্যামলিনের কাবাবি অভিষেক বোস হলফ করে বলাই যায়।