Spread the love

শ্রীজিৎ চট্টরাজ : ইংরেজ উপনিবেশে এদেশে ইংরেজি সাহিত্য চর্চায় বাঙালি অনুরাগী হয়েছে উনিশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন তাঁর সাহিত্য জীবনের প্রথম উপন্যাস রাজ মোহনস্ ওয়াইফ। কিন্তু সাদা চামড়ার সভায় যা স্বীকৃতি পায়নি। এরপর আর ইংরেজি সাহিত্য চর্চায় আগ্রহ দেখাননি তিনি। একই কথা মাইকেল মধুসূদনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ক্যাপটিভ লেডি তাঁর প্রথম ও শেষ ইংরেজি সাহিত্য রচনা। এরপর বাঙালি ওপর মহলে ফারসি ভাষার গুরুত্ব যেমন কমেছে ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা বেড়েছে। সেযুগের ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা ছিলেন আধুনিকতায় এগিয়ে। ঠাকুর বাড়ির শোভনাসুন্দরী স্বর্ণকুমারী দেবীর মত বাংলা সাহিত্যে তেমন মুন্সিয়ানা না দেখালেও ইংরেজিতে স্বর্ণকুমারী দেবীর কাহাকে উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ করেন টু হুম নামে। লন্ডনের ম্যাকমিলন কোম্পানি থেকে যা অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বঙ্গতনয়ার ইংরেজি সাহিত্য চর্চার বিসেই শুরু। তরু দত্ত,পদ্মজা নাইডুর ইংরেজি রচনার পর বিশ শতকের শেষ দিকে বুকার প্রাইজ জিতে বাঙালির নজরে আসেন অরুন্ধতী রায়। কমলা দাস ,ঝুম্পা লাহিড়ি, অনিতা দেশাই,শোভা দে, ইন্দিরা গোস্বামী ,কিরণ দেশাই , শশী দেশপান্ডে, চিত্রা ব্যানার্জি দিবাকারুনি ভারতী মুখার্জি, মিনা আলেকজান্ডার, ঋতিকা ভাজইরানি প্রমুখের মিছিলে নতুন নাম সংযোজিত হয়েছে নন্দিতা ব্যানার্জি।
নন্দিতা ব্যানার্জি কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস রচনাতেও সিদ্ধহস্ত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এ ও এম এ ডিগ্রি হাসিল করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে। স্বামীর কর্মসূত্রে সাগর পার। যুক্তরাষ্ট্রে টুলসা ওকলাহোমায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। গেছেন ব্রিটেনে। সেখানে অক্সফোর্ডের প্রত্যন্ত এলাকায় মিশেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। পি জি সি ই নিয়েছেন অক্সফোর্ড ব্রুকার্স থেকে। বিদেশ ঘুরেছেন স্বামীর কর্মসূত্রে। আগ্রহ নিয়ে স্থানীয় মানুষের সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। হিউস্টনে থিতু হয়েছেন। কলমে শব্দ রচনা করেছেন।সভ্যপদ নিয়েছেন হিউস্টন রাইটার্স গিল্ড ও দি হিউস্টন রাইটার্স হাউসে। অ্যামাজনে মিলছে এখন নন্দিতা ব্যানার্জির নবতম ইংরেজি উপন্যাস ইন বিটুইন দি উইস্প। এটি তাঁর তৃতীয় উপন্যাস সিরিজের সপ্তম পর্ব। প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয় অতীন্দ্রিয়। যেখানে জীবিত মানুষ, অশরীরী, ব্ল্যাক ম্যাজিক ,ট্যারট এর সং মিশ্রণে রহস্যের গন্ধ উপন্যাসের পরতে পরতে।

নন্দিতা ব্যানার্জি তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাসের প্রকাশ অনুষ্ঠান করলেন দক্ষিণ কোলকাতার এক ব্যুটিক রেস্তোরাঁয়। প্রতিবেদকের প্রশ্ন ছিল উপন্যাসের বিষয়বস্তু কেন অতীন্দ্রিয়? নন্দিতা ব্যানার্জি জানালেন, তাঁর ছোটবেলা কেটেছে বর্ধমানের রাণীগঞ্জ এলাকায়। ছোটবেলা দেখেছি পুনর্জন্মের ভিত্তিতে তৈরি সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা। আমাদের বাড়ি ছিল দামোদর ভ্যালি এলাকায়। সেখানে শুনেছি কিছু তান্ত্রিক তুকতাক করতেন। আমাদের এলাকার বাড়িগুলো ছিল ব্রিটিশ ঘরানার বাংলো বাড়ির মত। কিন্তু বাড়ি ঘিরে ছিল উঁচু পাঁচিল। প্রায়ই শুনতাম কোনো বাড়িতে তুকতাক হত। আমাদের বাড়িতেও হয়েছে। উঠোনে কেউ এসে একটি প্লেটে ফল ধুপ রেখে গেছে। বাড়ির কাজের লোকরা হাত দিয়ে সরাতে রাজি হলো না। বাড়ির এককোনে থাকা কয়লার স্তূপের পাশে রাস্তার এক কুকুর ছানা সেই ফলে মুখ দেয়। এরপর থেকে সাতদিন কুকুরটিকে দেখা মেলেনি। হঠাৎ ভোররাতে মিলল কুকুরটিকে। যেখানে সে ফলে মুখ দিয়েছিল সেখানেই সে মারা যায়। এছাড়া আমার এক বান্ধবীর বাড়িতেও তুক করা হয়। ফলে এই বিষয়ে ছোট থেকেই একটা মনে দাগ কেটেছিল। এরপর যখন আমি লিখতে শুরু করি বিদেশে তখন প্রথমে হোটেলে উঠেছিলাম। স্বামী কাজে।বাচ্চারা ঘুমোচ্ছে। সকালে কফি খেতে খেতে অনুভব করলাম আমার আশেপাশে বেশকিছু চরিত্র। লিখতে শুরু করলাম । কিভাবে লিখেছি আমি বলতে পারবো না। আজ তিরিশ বছর প্রবাসী। কোলকাতায় আসি প্রতি বছর।

বিজ্ঞানে সাইকোলজি বিষয় যেমন আছে তেম কিছু দশক থেকে প্যারা সাইকোলজি নামে অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে চর্চা চলছে। জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। তাই হলিউডে তৈরি হয়েছে কিছু সুপার হিট ভৌতিক ছবি। জার্মান সাইকোলজিস্ট ম্যাক্স দেসোর (১৮৬৭- ১৯৪৭) সাইকোলজির এই শাখাকে প্যারা সাইকোলজি নামে সংজ্ঞায়িত করেন। বিজ্ঞানের দরবারে স্বীকৃত না হোক রহস্যের অমোঘ আকর্ষণে যেমন পাঠক বা দর্শক সংখ্যা বাড়ছে তেমন সাহিত্য , সিনেমায় অতীন্দ্রিয় বিষয় সৃষ্টি বাড়ছে। নন্দিতা ব্যানার্জি তাঁর এই বইটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর স্বামী ও সেই সব বন্ধুদের যাঁরা নন্দিতার ওপরআস্থা রাখেন। এখন নন্দিতার এই সাহিত্য নির্মাণ পাঠক মনে কতটা নন্দিত হয় সেটাই দেখার। তবে বইটির দাম ভারতীয় মুদ্রায় বারোশ টাকার মত।