শ্রীজিৎ চট্টরাজ : রাম রাবণের লড়াই হবেক চাকলতোড়ের মোড়ে, ঢাক ঢোল আর ধামসা মাদল বাজেরে তাই জোরে।,,,,, ধামসা তালে উলফা দিবেক বাহারি মুহা পরে, খঁকরা পেটেও তাগদ দেখায় লাচে বাঁশির সুরে।,,,,,,, টাঁড়বাদের ছৌ লাচের ভাই কদর জগত জুড়ে,,,,, ছ্যাঁড়াফাটা জামার পকেট ভরায় কত খেতাব, নাই তবু জুটে শুখা রুটি নাই মিটল অভাব। ছৌয়ের লাগ্যে গরব করি দেশের মান বাড়ালে, কেউ ভাবি না উঁদের কথা ছৌ মুহার আড়ালে।২০১৪ সালে ছৌ মুহার আড়ালে শীর্ষক কবিতাটি লেখেন পুরুলিয়ার ভূমিপুত্র অরূপ গোস্বামী। আজও প্রাসঙ্গিক কবির বক্তব্য। ছৌ নাচের শিল্পীরা রাজ্য সরকারের পেনশন বাবদ হাজার টাকা পেলেও রুখা শুখা পুরুলিয়ার মুখোশ শিল্পীরা পান না কোনো সরকারি সাহায্য। আদিবাসী মন পেতে নির্বাচনের আগে নেপাল চন্দ্র সূত্রধর পেয়েছেন মরণোত্তর পদ্মশ্রী পুরষ্কার। একসময়ে সরকারি বিপণি মঞ্জুষা থেকে কিছু অর্ডার আসত। এখন অনেকদিন আগে থেকেই বন্ধ। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মেলায় কিছু বিক্রি বাট্টা হলেও সিন্ধুতে বিন্দু মাত্র। বছরের বেশির ভাগ দিন চাষের জমিতে কাজ করে বা মজুর খেটে ভুকা পেটের সংস্থান করতে হয়। অথচ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ভুরি ভুরি প্রশংসা মিলে আসছে। পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত প্রয়াত মুখোশশিল্পী নেপালচন্দ্র সূত্রধর আট বছর বয়স থেকে মুখোশ নির্মাণে ব্রতী ছিলেন। ২০২৩ এর নভেম্বর মাসে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এই প্রতিভাধর শিল্পী চিরঘুমের দেশে পাড়ি দেন। তিনপুরুষ ধরে মুখোশ শিল্পী এই পরিবারের পরবর্তী দুই প্রজন্ম এখন বাঁচিয়ে রেখেছেন পুরুলিয়ায় এই শিল্প নিজেদের পরিবারে। কিন্তু পেটের সংস্থানে নতুন প্রজন্ম আর এই ঐতিহ্যের ধারাকে ধরে রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। তাই ভবিষ্যতে এই শিল্পের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরুলিয়া কবিতায় লিখেছিলেন ,পাষাণময় যে দেশ , সে দেশে পড়িলে বীজকুল, শস্য তথা কখন কি ফলে? ,,,,,, বাড়ুক সৌভাগ্য তব এ প্রার্থনা করি, ভাসুক সত্যতা স্রোতে নিত্যতব তরি। কিন্তু সেই সৌভাগ্য থেকে আজও বঞ্চিত পুরুলিয়ায় ভূমিপূত্র মুখোশ শিল্পীরা। সাধারণত চৈত্র পরবে শিবের গাজন উপলক্ষ্যে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত ব্রাত্য পুরুলিয়ায় ভূমিপুত্র ছৌ নৃত্যের পরিবেশন করেন রূখা শুখা মাটিতে বৃষ্টি আনার জন্য প্রকৃতি দেবীকে আরাধনা করতে। কেউ বলেন ছায়া শব্দ থেকে ছৌ শব্দের উৎপত্তি। কেউ বলেন ছৌ শব্দের আঞ্চলিক অর্থ ছলনা। মুখোশের আড়ালে এই নৃত্য। কেউ বলেন ছাউনি থেকে ছৌ। সেনা ছাউনি শব্দের সঙ্গে সঙ্গতি রাখে এই বীররসের নাচ। অনেকে বলেন তিব্বতের আদিবাসী ছাম নৃত্য হয় মুখোশ পরে। তারই রূপ এই ছৌ নৃত্য। আবার মুন্ডা শব্দ ছক বা ছট থেকে ছৌ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: আশুতোষ ভট্টাচার্য ছো নাচকে ছৌ নাচ হিসেবে উল্লেখ করেন। পুরুলিয়ায় জৈন ধর্মের চর্চা স্থিমিত হয় হিন্দু বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে। ফলে আদিবাসী সংস্কৃতিতে রোজকার জীবনসংগ্রাম ছিল নাচের বিষয়বস্তু। হিন্দু প্রভাবে ছৌ নাচের বিষয় হয়েছে রাবণ বধ, মহিষাসুর বধ আলেখ্য। ছৌ নাচের বাদ্যযন্ত্র ঢোল, মাহুরি, চড়চড়ি, ধামসা ঘুঙুর, সানাই ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে বিশ্বায়নের ছোঁয়ায়। এসেছে ক্যাসিও।
আশার কথা, সরকারি উদাসীনতা থাকলেও এগিয়ে এসেছে বেশকিছু বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন। এমনই এক সংস্থা জিনিয়াস কনসালটেন্ট লিমিটেডের অধীনস্থ সমাজসেবী সংগঠন জিনিয়াস ফাউন্ডেশন ও অ্যাসেন্সিভ এডু স্কিল ফাউন্ডেশন যৌথ উদ্যোগে২০২৩ সালে এপ্রিল মাসে পুরুলিয়ার চরিদাতে ছৌ মুখোশ কারিগরের বাজার সংযোগ ও উদ্যোক্তা বিকাশের লক্ষ্যে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক বাজার তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনার জন্য নিজস্ব উদ্যোগে একটি তহবিলও গড়ে তোলা হয়েছে। গত এক বছরে অ্যাসেন্সিভ এডু স্কিল ফাউন্ডেশন সংস্থার প্রাণপুরুষ অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রায় ২০০ ছৌ মুখোশ শিল্পীদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। পাশাপাশি বিশ্ব বিপণনের জন্য ফ্লিপকার্টের মত ই কমার্স আঙিনায় আধুনিক মোড়ক ও কর্মশালা পরিচালনার ব্যবস্থা করেছে। প্রশিক্ষণের শেষে শিক্ষার্থীদের বাঘমুন্ডি ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক শংসাপত্র অর্পণ করেন। বুধবার দুপুরে কলকাতা প্রেসক্লাব অঞ্চলে ছৌ নাচের শিল্পী ও মুখোশশিল্পীদের নিয়ে একটি মিছিল সংগঠিত হয়। প্রেসক্লাবে হয় একটি সাংবাদিক সম্মেলন। উপস্থিত ছিলেন জিনিয়াস কনসালটেন্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর পি যাদব, জিনিয়াস কনসালটেন্টস লিমিটেডের ডিরেক্টর রশ্মি যাদব, অ্যাসেন্সিভ গ্রুপ অফ কোম্পানিজের চেয়ারম্যান অভিজিৎ চ্যাটার্জি, রাজ্য সরকারের শ্রম বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাওন সেন , কেন্দ্রীয় সরকারের টেক্সটাইল মন্ত্রণালয় ও ডিসি হস্তশিল্পের কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ( এইচ) সুদর্শন রায়, জিনিয়াস কনসালটেন্টস লিমিটেডের সি ই ও কৌশিক মজুমদার ডি জি এম প্রবীর চক্রবর্তী প্রমুখ। সন্মেলনে আগত ছৌ শিল্পী ও মুখোশশিল্পীদের আবেদন পুরুলিয়ায় একটি একাডেমী গড়ে তুললে একদিকে নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্যবাহী এই ছৌ শিল্পে আগ্রহী করে তোলা যাবে তেমনই বিপণনের ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ার সুযোগ ঘটবে। উদ্যোক্তাদের পক্ষে সাংবাদিকদের জানানো হয় বছরখানেকের মধ্যে ভূমিপুত্রদের এই দাবি বাস্তবায়িত হবে।
বিশ্বায়নের প্রভাবে ছৌ শিল্প সমৃদ্ধ হবে এটা যেমন ইতিবাচক দিক তেমন পুরুলিয়ার ছৌ শিল্পের মূল চারটি ধারা বাঘমুণ্ডি, বান্দোয়ান, ঝালদা ও আড়সা অঞ্চলের। এগুলির সংযুক্তি ঘটিয়ে একটি ধারার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে । ফলে চার অঞ্চলের যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এদিকে নজর রাখবে কে? এদিন অনুষ্ঠানে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে ছৌ শিল্পীরা যে ছৌ নৃত্য পরিবেশন করলেন দৃষ্টিনন্দন হলেও দেখা মিলল না শিল্পীদের পায়ে ঘুঙুর । দেখা মিলল না বাজনদারেদের মধ্যে ঐতিহ্যের সানাইবাদক।
Discover more from SRB News Bangla
Subscribe to get the latest posts sent to your email.