Spread the love

শ্রীজিৎ চট্টরাজ : বাঙালির ইতিহাসে বাঙালির রসনায় আসক্তির পরিচয় মেলে প্রাচীন যুগ থেকেই। নানা স্বাদের খাদ্যের মধ্যে নরম মাটির দেশ বাংলার মানুষের মিষ্টির প্রতি আলাদা অনুরাগ। সেই কবে মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাস লিখেছেন, সের অক্ক জঁ পাঅই ঘিত্তা/ মন্ড বিশ পকাইল নিত্তা। অর্থাৎ একসের ঘি পেলে প্রতিদিন বিশটি মন্ডা বানাই। ষোড়শ শতকের কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রী চৈতন্য চরিতামৃতে মিষ্টির বিবরণ দিতে লিখলেন কনক কটেরা ভরি , মধু মিষ্ট মুখে/ জলিখা তুলিয়া দেন্ত ইউসুফক মুখে/ ঘৃত মধু শর্করা বহুল দুগ্ধ দধি/ সুধারসে পুরিত সন্দেশ নানা বিধি। রবীন্দ্রনাথ যজ্ঞ ছোট গল্পে লিখেছেন, পাত্রের দল একদিন মেয়েটিকে পছন্দ করিয়া ক্ষীরের ছাঁচ , নারিকেলের মিষ্টান্ন ও নাটোরের কাঁচাগোল্লা খাইয়া গেল। আসিয়া তবে প্রাচীন যুগে ভারত বা বাংলায় ছানার মিষ্টির প্রচলন ছিল না । এব্যাপারে আমরা পর্তুগিজদের কাছে ঋণী। সেযুগে বাংলার সন্দেশ তৈরি হত ডোলো চিনি ,ক্ষীর ও খোয়া ক্ষীর দিয়ে। সেযুগে খেজুর আর আখের চাষে বাংলা ছিল প্রথম সারিতে। ফলে ডোলো চিনির প্রচলন ছিল বাংলায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি পরিব্রাজক ফ্রাসোয়া বার্নিয়ের দেশে ফিরে ভ্রমণ পঞ্জিতে লেখেন বাংলাদেশে যেখানে পর্তুগিজরা বাস করে সেখানে ছানার তৈরি মিষ্টির ব্যবসা বাড়ছে। দুধ কে ছিন্ন করে যে বস্তু মেলে তাই ছ্যানা। ছানা। ছানার মিষ্টির প্রচলন ব্যাপক হয় উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে।

কলকাতায় তখন নবীনচন্দ্রকে আখ্যা দেওয়া হলো রসগোল্লার কলম্বাস হিসেবে। বাংলার আরেক প্রান্তে তখন সতীশ ময়রার খ্যাতি। তাঁর নির্মাণ গুঠিয়া সন্দেশ। গরুর দুধের ঘ্রাণে সেই সন্দেশের উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের বরিশালের গুঠিয়া অঞ্চল। সতীশ ময়রার ব্যবসা ১৮৪০ সালে শুরু হলেও দক্ষিণ কলকাতার গার্ডেনরিচ অঞ্চলের প্রথম দোকান স্থাপিত ১৯২০ সালে। এখন চতুর্থ প্রজন্মের হাতে দায়িত্ব মিষ্টান্ন নির্মাণের। জন্মাষ্টমীর সময়ে এই সতীশ চন্দ্র দাস অ্যান্ড সন্স নির্মাণ করেন তালের বড়া, তালের পায়েস , তালের তুলসি মালাই বা পেল্লাই মতিচুরের লাড্ডু যিনি খাননি তাঁর মিষ্টি প্রেমী হিসেবে দাবি করা ঘোর অন্যায় হবে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার গার্ডেনরিচ অঞ্চলে সতীশ চন্দ্র দাস অ্যান্ড সন্স প্রতিষ্ঠান ও সতীশ ফুডস এর অন্যতম চতুর্থ প্রজন্মের অন্যতম কর্ণধার এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সুইট টেকনোলজি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট সেন্টারের অন্যতম আধিকারিক অরূপ দাস সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হলেন। উপলক্ষ পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর উপায়ে মিষ্টান্ন নির্মাণের কারিগর তৈরির প্রথম প্রকল্পে উত্তীর্ণ তিরিশ জনকে স্বীকৃতি প্রদান। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট জনের উপস্থিতির তালিকায় ছিলেন রাজ্যের বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দোপাধ্যায়, রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা, কে সি দাস মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও মিষ্টি উদ্যোগের সভাপতি ধীমান দাস, মুখরোচক চানাচুরের কর্ণধার প্রণব চন্দ্র, স্থানীয় ১৫ নং পুর বোরোর চেয়ারম্যান রঞ্জিত শীল , সতীশচন্দ্র মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় প্রজন্মের হোতা সুরেশ চন্দ্র দাস প্রমুখ। অরূপদাস জানালেন , আমাদের প্রতিষ্ঠান একশ বছর অতিক্রম করেছে দুবছর আগেই। তাই ব্যবসার পাশাপাশি একটা সামাজিক দায়িত্বকে অস্বীকার করতে পারি না। বাংলার ঐতিহ্য মিষ্টান্ন। জনপ্রিয়তা বাংলা ছাড়িয়ে ভারত তথা বিশ্বে প্রথম সারিতে। এই ঐতিহ্যের রাশ ধরতে এবং যুগের দাবি মেনে পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর মিষ্টান্ন নির্মাণে নতুন কারিগর নির্মাণের প্রয়োজন। তাই রাজ্য সরকার বিশেষ করে বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দোপাধ্যায় ও মিষ্টি উদ্যোগের সভাপতি ধীমান দাসের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এম এস এম ই প্রকল্পে মিষ্টান্ন শিল্পী নির্মাণের এক শিক্ষাক্রমে প্রথম অধ্যায়ে তিরিশজন সাড়ে চারশো ঘণ্টার সময়সীমার পাঠক্রমে স্বীকৃত সমাবর্তনে তাঁদের হাতে স্মারক তুলে দিয়ে আমরা গর্বিত। আশা করা যাচ্ছে আগামী পাঁচ বছরে দেড় লক্ষ বেকারকে কাজ শিখিয়ে কর্মসংস্থান দেওয়া সম্ভব হবে। ইতিমধ্যেই কে সি দাশ প্রতিষ্ঠান এই শিক্ষাক্রমে উত্তীর্ণ কয়েকজনকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। মন্ত্রী শশী পাঁজা অনিবার্য কারণ বশত না আসতে পারার কথা জানিয়ে অরূপ দাস বলেন মন্ত্রীএই সভায় এসে ঘোষণা করতেন নতুন শিল্পোদ্যোক্তারা যাঁরা মিষ্টান্ন ব্যবসায় আসবেন তাঁদের মূলধনের পঞ্চাশ শতাংশ পুঁজি রাজ্য সরকার দেবে।

রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্যে বলেন, মিষ্টি বাঙালির সংস্কৃতি। এই শিল্পকে বাঁচাতে নতুন শিল্পী নির্মাণের যে কর্মযজ্ঞ হচ্ছে সেটা ইতিবাচক। রাজ্য সরকারের মূলধন দেওয়ার যে ঘোষণা করা হল সেটা বিধানসভায় স্বীকৃত না হলে কিভাবে ঘোষিত হল সেটা কতটা আইনত প্রশ্ন উঠতে পারে। ধীমান দাস বলেন, এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আমি একজন মিষ্টান্ন ব্যাবসায়ী ও মিষ্টি উদ্যোগেরসভাপতি হিসেবে এই উদ্যোগের পাশে আছি। নতুন প্রজন্মের অরূপ দাসের হাত ধরে নতুন প্রজন্মের মিষ্টি শিল্পী ভারত তথা বিশ্বে বাংলার ঐতিহ্য আরও ব্যাপ্তি পাবে এটা সুখের কথা। প্রতিবেদকের প্রশ্ন ছিল , রাজ্য প্রশাসনের তরফে মিষ্টির জীবনকালের সময় নির্ধারণের এক বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। কিন্তু মিষ্টি ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে সেটা ঠান্ডা ঘরে চালান হয়ে গেছে। জবাবে ধীমান বললদাস জানালেন, আমাদের বিরোধিতা ছিল সিদ্ধান্তের বাস্তবতা নিয়ে। প্রতিদিন সম্ভব নয় রোজ একশ রকমের মিষ্টির সময়সীমার ট্যাগ লাগানো। একটা বাস্তব পদ্ধতি নির্ধারণ হলে আপত্তি কিসের? এদিন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তিরিশ জন ছাত্রছাত্রীদের হাতে শংসাপত্র তুলে দেওয়া হয়। উদ্যোগ শুভ, কিন্তু বাস্তবে নিখরচারএই উদ্যোগ কতটা কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয় সেটাই দেখার। মনে রাখা দরকার ছোট বড় ও পারিবারিক ব্যবসায় বাংলায় জড়িত প্রায় ১০ লক্ষ মিষ্টান্নশিল্পী। প্রয়োজনের অনুপাতে কম। একদিকে কর্মসংস্থান অন্যদিকে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নশিল্পকে এক নতুন মাত্রায পৌঁছে দেওয়া সেই কাজটির কান্ডারি অরূপ দাস।