Spread the love

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : সম্প্রতি রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে তৃণমূল সাংসদ বলেন কেন্দ্রীয় সরকার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আয়ুষ প্রকল্পের মাধ্যমে বিকল্প চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির মত একটি অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাকে অযৌক্তিক ভাবে যুক্ত করেছে। সংবাদটি প্রকাশ্যে আসায় তীব্র প্রতিবাদে সরব হয়েছে দেশের হোমিওপ্যাথি ওষুধ নির্মাতারা এবং স্বনামধন্য হোমিও চিকিৎসকেরা। মঙ্গলবার সকালে মধ্য কোলকাতায় বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক রথীন চক্রবর্তীর চিকিৎসাকেন্দ্রে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে দি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল এসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া ও ন্যাশনাল আয়ুষ টাস্ক ফোর্স, অ্যাসোচেম। অসমর্থিত সূত্রে পাওয়া খবর, বিক্ষোভের আঁচ পেয়ে অভিযুক্ত সাংসদ ৩৬০ ডিগ্রি বিপরীতে গিয়ে বলেছেন, তিনি হোমিও চিকিৎসাকে ব্যক্তিগত ভাবে বিরোধিতা করেননি আধুনিক চিকিৎসকদের বক্তব্যকে তুলে ধরেছিলেন।

সন্মেলনে হাজির ছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তি হোমিও চিকিৎসক ভোলানাথ চক্রবর্তীর পুত্র হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র ডা,: রথীন চক্রবর্তী, হোমিওপ্যাথি মেডিকেল সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ডা,: শহিদুল ইসলাম ও ন্যাশনাল আয়ুষ টাস্ক ফোর্স, অ্যাসোচেমের চেয়ারম্যান ডা: সুদীপ্ত নারায়ণ রায়। ডা: রায় বলেন, রাজ্যের তৃণমূল সাংসদ রাজ্যসভায় এক দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে হোমিও চিকিৎসাকে অবৈজ্ঞানিক আখ্যা দিয়ে দেশের হাজার হাজার হোমিও চিকিৎসকদের শুধু নয়, কোটি কোটি হোমিও চিকিৎসাধীন রোগীদের অপমান করেছেন। বিশ্বে কোথাও হোমিও চিকিৎসা নিষিদ্ধ নয়। তবু তিনি বিকৃত তথ্য পরিবেশন করেছেন কাদের ইঙ্গিতে ? এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মন্তব্যের বিরূদ্ধে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান,কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ বিভাগের প্রধান ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ পত্র পাঠানো হয়েছে। আমরা সাংসদ সাকেত গোখেলের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা দাবি করছি। আশা করছি , মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হোমিও চিকিৎসক ডা: রথীন চক্রবর্তী বলেন, এই অবার্চিন সাংসদের মন্তব্যের বিরোধিতা করা আমার শিক্ষা সংস্কৃতির পক্ষে রুচিকর নয়। তবু বলতে হচ্ছে বিশ্বের চিকিৎসাধারা ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ওপর তাঁর জ্ঞানের পরিধি কতটা? এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য লজ্জার। হোমিও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ শহিদুল ইসলাম বলেন, রাজ্যের শাসকদলের সাংসদ যদি দ্রুত ক্ষমা প্রার্থনা না করেন তাহলে দেশ জুড়ে আমরা পথে নামব।

উল্লেখ করা যেতে পারে, বহু যুগ ধরেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল ধারার চিকিৎসকেরা হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানকে ছদ্ম বিজ্ঞান নামে অভিযুক্ত করে আসছেন। আমেরিকার জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত should we maintain in open mind about homiopyathy শীর্ষক এক প্রবন্ধে মাইকেল বম ও নবএডওয়ার্ড আন্স লিখেছেন, হোমিওপ্যাথি বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠা চিকিৎসা পদ্ধতির নিকৃষ্টতম উদাহরণ।২০১৩ সালে স্যার মার্ক ওয়ালপোর্ট, যুক্তরাজ্যের সরকারি প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা বলেছেন, হোমিওপ্যাথিতে কোন বিজ্ঞান নেই। এটি সর্বোচ্চ স্তরের প্ল্যাসিবো চিকিৎসা। অধ্যাপক জন বেডিংটন বলেছেন, হোমিওপ্যাথি একটি পাগলামি। বিশ্বের বিভিন্ন যুক্তিবাদী সংগঠন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে কৃতকার্য হলেও পেশা হিসেবে হোমিওপ্যাথি বেছে নিয়েছেন। এই তথ্যের জ্বলন্ত উদাহরণ ডা মহেন্দ্র সরকার। যিনি আধুনিক চিকিৎসা যা সেযুগে ইংলিশ মেডিসিন ডাক্তার হিসেবেপরিচিত ছিলেন সেই মহেন্দ্রলাল সরকার। পরবর্তী সময়ে হোমিপ্যাথিক চিকিৎসায় আস্থা রাখেন।রামকৃষ্ণদেবের হোমিও চিকিৎসা করতেন তিনি। সমসাময়িক সময়ে প্রয়াত বিশিষ্ট চিকিৎসক ভোলানাথ চক্রবর্তী এ্যালোপ্যাথি পাঠক্রমে উত্তীর্ণ হলেও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ব্রতী হয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। একই পথ অনুসরণ করেছেন হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র রথীন চক্রবর্তী। নাম না করেও যুক্তিবাদী ত্রৈমাসিক উৎস মানুষ পত্রিকায় মডার্ন মেডিসিন বনাম হোমিওপ্যাথি শীর্ষক নিবন্ধে অর্ক বৈরাগ্য , অতীতে ও বর্তমানে একাধিক অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক হোমিওপ্যাথিতে ঝুঁকছেন কেন ও সেই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করছেন কেন প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন, এর কারণটি মূলত দার্শনিক। অন্যভাবে বললে হোমিওপ্যাথির যে ভাইটালিজম তথা এম্পিরিসিজম -এর দর্শন তার প্রতি অনেক চিকিৎসকই আকর্ষিত হয়েছেন। এই দর্শনের সাথে প্রকৃতপক্ষে জড়িয়ে রয়েছে আধ্যাত্মিকতা তথা ধর্মীয় বিশ্বাসব্যবস্থা।,,,,,,, হ্যানিম্যান তাঁর অর্গানন বইতে (১৮১০) লিখেছেন যখন কোন ব্যক্তি অসুস্থ হয় তখন আসলে এই আধ্যাত্বিক, স্বয়ংক্রিয় এবং অশরীরী ভাইটাল ফোর্স বা সেই ব্যক্তির সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে উপস্থিত রয়েছে, সেটি ভারসাম্যচ্যুত হয়,,,,, তাই নিজের ব্যক্তিগত যাপনে ও দর্শনে যে সমস্ত ব্যক্তি/ চিকিৎসক আধ্যাত্বিকতা তথা পরম কল্যাণময় ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী তারা অবচেতনেই হোমিওপ্যাথি দর্শনে আকৃষ্ট হন।,,,,,( ৪ র্থ বর্ষ,৪ র্থ সংখ্যা, অক্টোবর ডিসেম্বর ২০২০, পৃষ্ঠা ৪০)

যদিও এই যুক্তি একশ শতাংশ সত্যি বলা সম্ভব নয়। কারণ বহু অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে বিশেষ করে শল্য চিকিৎসকেরা বলে থাকেন চিকিৎসার শেষে ওপরওলার হাত। তবে হোমিও বিরোধিতা শক্তিশালী হয়ে ওঠে ইউরোপের ১৮ শতাব্দীর হোমিও চিকিৎসকদের পারস্পরিক কলহে। হোমিও ইতিহাসে ডা: ম্যুলার ও হোমিপ্যাথিক তত্ত্বের জনক হ্যানিম্যানের দ্বৈরথ। জার্মানির নাৎসি রুডলফ ভিরকো হোমিপ্যাথিক হাসপাতালের প্রধান ডা: ফ্রিৎজ ডনার যখন বলেন হোমিও চিকিৎসা ছদ্মবেশী সাইকোথেরাপি। নিজে হাঁপানির চিকিৎসক হয়েও বলেন হোমিও চিকিৎসায় হাঁপানি সারে না। এই আক্রমনের জবাব দিতে গিয়ে সাংবাদিক সন্মেলনে এই প্রতিবেদককে ডা: রথীন চক্রবর্তী জানান, বিজ্ঞান কখন স্থির সত্যের কথা বলে না। কাল যা অবৈজ্ঞানিক ছিল আজ তা বিজ্ঞানসম্মত হিসেবে ঘোষিত হচ্ছে। কাল যা বিজ্ঞানসম্মত ছিল , আজ সেটা অবৈজ্ঞানিক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। সুতরাং বিজ্ঞানের এক শাখা হিসেবে অতীতের কোনো সিদ্ধান্ত পরীক্ষানিরীক্ষায় আজ সশোধিত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। রাজ্যসভায় তৃণমূল সাংসদ সাকেত গোখলের বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় যুক্ত চিকিৎসক, ওষুধ নির্মাণকারী সংস্থাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হয় সেটাই দেখার।